মানুষের ভারে বিপন্ন রাঙামাটি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাহাড়ঘেরা সবুজ রাঙামাটি শহরের ভূ-প্রকৃতি সর্বোচ্চ ২৫ হাজার মানুষকে বসবাসের জন্য জায়গা দিতে পারে। কিন্তু শহরে ধারণক্ষমতার অন্তত ছয় গুণ মানুষ থাকছে। নিয়ন্ত্রণহীন জনংখ্যার চাপ সামলাতে পারছে না সেখানকার প্রকৃতি। এর সঙ্গে পাহাড় কাটা, গাছ উজাড় আর অপরিকল্পিত উন্নয়নও যুক্ত হয়েছে। এসবের প্রতিক্রিয়ায় বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে শহরটি।

রাঙামাটি পৌরসভার আয়তন ৬৪ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৩২ বর্গকিলোমিটারই কাপ্তাই লেক ও বসবাসের অনুপযোগী অঞ্চল (পাহাড়ের ঢাল)। বাকি ৩২ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার পাহাড়। পৌরসভা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শহরে ভোটারের সংখ্যা ৬৮ হাজার ৫৭০ জন। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। অথচ ২০০১ সালেও পৌরসভার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৭ হাজার। অর্থাৎ, ১৬ বছরে শহরের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ সুবর্ণ চাকমা হাওর বার্তাকে বলেন, পরিকল্পিত নিরাপদ নগর করা হলে শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাত থেকে আট শতাধিক মানুষ বসবাস করতে পারবে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৬০০ মানুষ বাস করার মতো অবস্থা রয়েছে।

তবে পৌর কর্তৃপক্ষের জনসংখ্যার হিসাবের সঙ্গে একমত নন রাঙামাটি নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান এবং শহরের প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে। তাঁরা হাওর বার্তাকে বলেন, পৌরসভার হিসাবের চেয়েও প্রায় এক লাখ বেশি মানুষ শহরে বসবাস করে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শহরটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

প্রতিবছর রাঙামাটি বেড়াতে যায় কয়েক লাখ পর্যটক। তাদের অনেকেই রাত কাটায় শহরে। পর্যটকের বাড়তি চাপও সইতে হচ্ছে শহরটিকে।

রাঙামাটি জেলার বর্তমান জনসংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার। আয়তন ৬ হাজার ১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। এই তথ্য জাতীয় তথ্য বাতায়নের।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের পর রাঙামাটি শহরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। শহরে আসা নতুন মানুষের জন্য পরিকল্পিত বসতি স্থাপনের বিষয়ে রাঙামাটি জেলা ও পৌর কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নজরদারি ছিল না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষগুলোও কোথাও উদাসীন ছিল, আবার কোথাও অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনে জড়িত ছিল বলে জানান পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল বলেন, বর্তমানে রাঙামাটির পাহাড়-গুলোতে যে বসতি গড়ে উঠেছে, তা নির্মাণের সময় ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড (গৃহনির্মাণ কোড) মানা হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মানুষের বসবাসের কারণে পাহাড়গুলোর বহনক্ষমতা হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ফলে বসবাসে ঝুঁকি বেড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষের কারণে জেলার প্রত্যন্ত এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন বিভিন্ন সময়ে শহরে এসে থাকতে শুরু করে। পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং পাহাড়ে আনারস, আদা ও হলুদের চাষাবাদকে কেন্দ্র করে বাঙালিদেরও বসতি বাড়তে থাকে। গত দুই দশকে পৌরসভার জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল হাওর বার্তাকে বলেন, রাঙামাটি শহরের জেলা প্রশাসকের বাংলো, পুলিশ সুপারের বাংলোসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা খুবই অপরিকল্পিতভাবে হয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় এসব বাংলো ও স্থাপনা দৃষ্টিনন্দন করার ক্ষেত্রে যেভাবে নজর দেওয়া হয়েছে, সেভাবে পরিকল্পিত উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হয়নি।

গত ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে রাঙামাটি জেলায় ১২০ জন প্রাণ হারায়। এর মধ্যে শহরে মারা যায় ৭৩ জন। শহরের ভেদভেদী এলাকাতেই ৪৬ মানুষ মারা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ২০০৭ সালে থেকে শহরের ভেদভেদীসহ আশপাশের এলাকায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি বসতি শুরু হয়। প্রতিবছর এসব বসতি বাড়তে থাকে। শহরের বিভিন্ন পাহাড় ও টিলার চূড়া, ঢাল ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি স্থানে

এখনো প্রায় ১০ হাজারের বসতি রয়েছে। নতুনপাড়া, শিম্বুলতলী, রূপনগর, পশ্চিম মুসলিম পাড়া, বিএডিসি কলোনি, পোস্ট অফিস কলোনি, উলুছড়া, আলুটিলা, কিনামনি ঘোনা, মোনতলা, যুব উন্নয়ন এলাকা ও মোনঘর আবাসিক এলাকায় এসব বসতি গড়ে উঠেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বসতিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ রয়েছে।

শর্ত সাপেক্ষে বসতিগুলোতে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান রাঙামাটি বিদ্যুৎ বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার। তিনি  বলেন, শর্ত হচ্ছে জেলা প্রশাসন যখন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবে, তখন তারা কোনো অভিযোগ করতে পারবে না। তিনি বলেন, প্রকৃত নিয়ম অনুসরণ করলে কেউ সংযোগ পেত না। তাদের বসতির ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থা না করলে চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করত। চুরি ঠেকাতে যে জনবল দরকার, তা তাঁদের নেই। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগ দিয়েছেন তাঁরা।

শহরের রূপনগর এলাকার গৃহবধূ ফাতেমা বেগম প্রায় তিন বছর আগে সরকারি পাহাড়ে বসতি গড়ে তোলেন। তাঁর স্বামী কবির আহমেদ দিনমজুর। ফাতেমা বেগম গতকাল বুধবারর হাওর বার্তাকে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে তাঁরা নোয়াখালী থেকে রাঙামাটি শহরে আসেন। প্রথমদিকে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তিনি বলেন, মিথ্যা বলে লাভ নেই, কয়েক বছর আগে এই জায়গাটি দখল করে তাঁরা ঘর তুলেছেন। পাহাড়ধসে তাঁদের ঘরটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অবৈধ বসতির বিষয়ে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বলেন, ‘এখানে পাহাড়ের ৯০ ভাগ বসতি অবৈধ। তাদের কাছে কোনো আরএস কিংবা বিএস খতিয়ান নেই। এগুলো চিহ্নিত করতে অনেক সময়ের দরকার। আবার এসব বসতিতে বিদ্যুৎ-সংযোগও দেওয়া হয়েছে। আবার বসতিগুলো পৌরসভার হোল্ডিংভুক্তও। এখন আমরা কোথায় যাব বলেন?’

গত ১৩ জুন রাঙামাটিসহ পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসের পর এর কারণ অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে একটি অনুসন্ধান কমিটি করা হয়। এই কমিটির প্রধান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা। সম্প্রতি তিনি পাহাড়ধসে রাঙামাটির ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

জানতে চাইলে সত্যব্রত সাহা মুঠোফোনে হাওর বার্তাকে বলেন, ‘পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্বচক্ষে দেখেছি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়েছি। কাদের পাহাড়, কীভাবে দখল হয়েছে এসব। আমাদের কাজ এখনো চলছে। আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সুপারিশ আকারে দেব।’ এই মাসের শেষ দিকে নয়তো সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদনটি দেওয়া হতে পারে।

২৫,৬০০ জনের বসবাসের জায়গা রয়েছে রাঙামাটি পৌরসভায়

৬ গুণবেশি মানুষ থাকছে সেখানে

১৬বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে

৬৪.৭৫বর্গকিলোমিটার আয়তন রাঙামাটি পৌরসভার

৩২ বর্গকিলোমিটার কাপ্তাই লেক ও বসবাসের অনুপযোগী অঞ্চল

৩২.৭৫ বর্গকিলোমিটার পাহাড়ি এলাকা বসবাসের উপযোগী

সূত্র: রাঙামাটি পৌরসভা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর